সাম্প্রতিক

চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব: চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বিপ্লব

সাম্প্রতিক শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:৪২:২১

চীনে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর তার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায় চীনের মত একটি বিশাল রাষ্ট্রকে একটি বৃত্তে নিয়ে আসা এবং সকল ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন করা। কেননা তখন চীনে প্রায় ৪০ উর্ধ জাতি গোষ্ঠীর লোকজন বসবাস করতো। ফলে তাদের এক কেন্দ্রে এনে শাসন করার লক্ষ্যে মাও সেতুং সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামে আরেকটি বিপ্লবের ঘোষণা দেন। যেটি ইতিহাসে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ক্ষেত্রেই স্থান করে নিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মত সাংস্কৃতিক বিপ্লবেও মাওসেতুং কতটুকু সফল এ সম্পর্কে জানতে হলে এই বিপ্লবের সূত্রপাত থেকে শুরু করে এর সমাপ্তি পর্যন্ত সামগ্রিক বিষয়গুলা জেনে আসতে হবে। চলুন একনজরে দেখে আসা যাক চীনের মাওসেতুং এর দ্বিতীয় বিপ্লব তথা সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর চীনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই সমাজতন্ত্র কে ধরে রেখে চীনের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করা। সমাজতন্ত্রীদের মতে এই উন্নয়নের পথে  অন্যতম বাধা হলো প্রতিবিপ্লবী ও পুঁজিবাদীরা। সুতরাং চীনকে সম্পুর্নরূপে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তারমধ্য অন্যতম ছিল সমষ্টিগত মালিকানার প্রবর্তন ও সমষ্টিগত কৃষির সূত্রপাত। এই নীতি অনুযায়ী চীনের সকল কৃষক -শ্রমিক রাষ্ট্রিয় কৃষির উন্নয়ন কাজে শ্রম দিত। কিন্তু পাশাপাশি কৃষকদের কে অল্প ভূমি দেয়া হয় যাতে বাড়িঘর ও সীমিত আকারে ফল-ফসলাদির চাষাবাদ করতে পারে। তবে এই ব্যবস্থার কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল যে কৃষকদের নিজস্ব অধীনে যে সীমিত সম্পদ দেয়া হয়েছিল কৃষকরা সেখানেই অধিক শ্রম দেয়া শুরু করলো। এতে পুঁজিবাদীদের ও একটি হাত রয়েছিল বলে মনে করা হতো। অর্থাৎ প্রতিবিপ্লবী ও পুঁজিবাদ পন্থীরা কৃষক-শ্রমিকদের ভিতরে আবার পুঁজিবাদী চিন্তা চেতনার বীজ রোপন করতে নেমে গেল। এই ব্যবস্থা থেকে উত্তরন ও পুঁজিবাদ পন্থীদের সমুলে বিলুপ্ত করার জন্য মাওসেতুং আরেকটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালের শুরুর দিকে এই পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করা হয় এবং এই বিপ্লব কে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই পরিকল্পিত বিপ্লবকে দেখভাল করার জন্য পেঙ ঝেন-এর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যে যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব বাস্তবায়িত হতে থাকল, একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকল, তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে মাও সেতুঙ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের পুরনো সিদ্ধান্ত বাতিল করে একের পর এক নতুন পদক্ষেপ ঘোষণা করতে হল। পার্টির উপরতলায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নেতৃত্ব হিসেবে ‘পাঁচজনের গোষ্ঠী’ ভেঙে দিয়ে ‘কালচারাল রেভলিউশন গ্রুপ’ তৈরি করা হল। পার্টির সদর দপ্তর মাও-সঙ্গীদের আখ্যা অনুযায়ী আড়াআড়ি ‘বুর্জোয়া সদর দপ্তর’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক সদর দপ্তর’-এ ভাগ হয়ে গেল।  

১৯৬৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে ‘বড়ো হরফের পোস্টার’ লিখনের মধ্য দিয়ে শহরাঞ্চলে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। এই পোস্টারগুলির তলায় স্বাক্ষর করা হয়েছিল ‘রেডগার্ড’। তাছাড়া এই পোস্টারের কয়েকটি কপি স্বয়ং মাওয়ের হাতে লিখিত হয়। এই পোস্টারগুলো ছিল মুলত পুরাতন ও পশ্চিমা ধ্যানধারণা হতে চীন কে মুক্ত করে তদস্থলে সম্পুর্ন নতুন ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ এটিকে চিন্তা বা মানসিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর এই বিপ্লব কে বাস্তবায়ন করার জন্য রেডগার্ড বাহিনী গঠন করা হয়। শুরুর দিকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র/যুবক নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই রেড গার্ড বাহিনীর সংখ্যা  ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ যুবক শহরে এসে এই বাহিনী তে যোগদান করতে থাকে। যেহেতু এই বিপ্লবে সরাসরি মাওয়ের সমর্থন ছিল তাই অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ,লক্ষ যুবক ও ছাত্র এই বাহিনী তে যোগদান করে। বলা হয়ে থাকে যে এই বাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৫০/৬০ লক্ষ সদস্য এতে যোগদান করে।

এই রেড গার্ড বাহিনীর কার্যক্রমের সূচনা হয় শহর অঞ্চলে। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রদানত -পুঁজিপতি,(প্রতিবিপ্লবী) পুরাতন ধ্যানধারণা ও পুরাতন ঐতিহ্য। চারটি পুরোনো জিনিসের বিরুদ্ধে শুরু হলো তাদের অভিযান । পুরোনো অভ্যাস, পুরোনো ধ্যান ধারণা, পুরোনো ঐতিহ্য আর পুরোনো সংস্কৃতি। তারা লোকের বাড়িঘরে ঢুকে পুরাতন আসবাবপত্র ভেঙে দিতে লাগলো। যেসব প্রসাধনী বিক্রি করে এমন দোকানও ভেঙে দিতে লাগলো তারা। করো চুল বেশি লম্বা মনে হলে তাকে ধরে চুল কেটে দেয়া হতে লাগলো। অর্থাৎ এই রেড গার্ড বাহিনীর কাছে যা কিছুই পুরাতন মনে হতো তার সব কিছুই ধ্বংস করে দিত। এমন কি চীনের কনফুসিয়াস মতবাদ কেও ধ্বংস করার জন্য তারা উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কে পুরাতন ও পুঁজিবাদী মতবাদের প্রচারক বলে অপমান করত। তাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন চীনা ভূস্বামীরা। বিপ্লবীরা তাদের পুরাতন আসবাবপত্র থেকে শুরু করে তাদের সকল সম্পত্তি কেড়ে নিত। তাছাড়া শহরের সকল সাধারণ মানুষকেও পরোক্ষভাবে রেড গার্ড বাহিনীর কথায় চলতে হতো। অর্থাৎ সম্পুর্ন পরিস্থিতি চীনা প্রশাসনের অধীনে নয় বরং রেড গার্ডের অধীনে পরিচালিত হতে থাকে। ফলে পার্টি এবং মাও প্রশাসন অভয়ই রেড গার্ডের কার্যকলাপে বিচলিত হয়ে পড়ে। ফলে এই অবস্থায় মাওয়ের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাড়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।

মাও এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব তুলে দিয়ে রেড গার্ড কে নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য নেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এতোদিনে রেড গার্ডদের সাথে সামরিক বাহিনীর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। ফলে তাদের দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো। অন্যদিকে মাও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন দমন পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে পারেন নি। কেননা তখন তারা ছিল সুসংগঠিত একটি বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তারা যদি পাল্টা আবার কোন বিপ্লব করে বসে তাহলে এটি হবে আরও একটি ভয়াবহ ব্যাপার। তাই মাও ও তার প্রশাসন মিলে একটা পরিকল্পনা করলেন যেন এই রেড গার্ড বাহিনী কে সুকৌশলে ঐক্যহীন করে দুর্বল করে দেয়া যায়। এজন্য রেড গার্ড বাহিনীর সদস্যদের কে গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষক শ্রমিকদের সাথে যোগ দিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে মাও এর এই নির্দেশ অনেকটা বাধ্য হয়ে রেড গার্ডের সদস্যরা মেনে নেয়। যখন তারা একে একে গ্রামে চলে যেতে থাকে তখন থেকেই কার্যত এই বিপ্লব স্তিমিত হয়ে যেতে থাকে। এবং ১৯৬৯ সালের মধ্যে এই এই বিপ্লবের আনুষ্ঠানিক  সমাপ্তি পর্ব শুরু হয়ে যায়। তবে এই বিপ্লবের রেশ আরও অনেকটা সময় পর্যন্ত বেচে ছিল। প্রায় আশির দশক পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিকভাবে এই বিপ্লব বজায় ছিল।

চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয় রেড গার্ডের কার্যকলাপে তাতে অনেকটাই ভাটা পড়ে। তবে চীনের পরবর্তী ইতিহাসে এটি বেশ অবদান রেখেছিল। চীনের মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখতে শুরু করে। নতুন জ্ঞান চর্চা করতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে চীন আজকের এই অবস্থায় এসে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে। মাও সেতুং ১৯৭৬ সালে মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি চীনকে একটি নতুন ভাবধারায় পূর্নাঙ্গরূপে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য লড়াই করে গেছেন।

তথ্য সূত্র
১.https://www.bbc.com/bengali/news-38187797

২.https://sites.google.com/site/manthansamayiki/2010_mj_3

৩.https://sites.google.com/site/manthansamayiki/2010_jf_2

৪.http://www.bangarashtra.net/article/445.html


লেখকঃ ফরিদ মোল্লা