ঢাকার বিভিন্ন স্থানের ধারাবাহিক ইতিহাস- পর্ব এক
মুঘল আমলে রাজধানী হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজধানীর ইতিহাস গুরুত্বের সাথে শুরু হয়, আলোচিত হয় জংগলাকীর্ণ অঞ্চলের সমৃদ্ধির কেচ্ছাকাহিনী। যদিও বলা হয়ে থেকে ঢাকার বয়স চারশো বছর কিন্তু কিছু দুর্লভ সূত্র বলছে এ সীমা অতিক্রম করতে পারে হাজার বছর। অর্থ্যাৎ ঢাকা শহরের বয়স প্রায় এক হাজার বছর৷ মূল সমস্যা এ জায়গায় যে মুঘল রাজধানী হওয়ার আগ পর্যন্ত এ নগরী খুব একটা পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি। যদিও সেসময়ে নগরী না বলে 'ঢাকার অস্তিত্ব' বলা যেতে পারে৷ ১৬০৮ সালে যখন সুবাদার ইসলাম খাঁ এ জনপদে আসেন তখন থেকেই মূলত এ নগরের সমৃদ্ধির যাত্রা শুরু হয়৷ জংগল কেটে বানানো হয় নতুন অঞ্চল৷ বুনো পরিবেশ থেকে পালটে ঢাকা হয়ে যায় এক নতুন শহর। আজকের ঢাকার বিভিন্ন স্থান একসময় ছিল অতি মনোরম। পাখির কলকাকলি, নদীর কলতান, জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ ছিল প্রায় প্রত্যেকটি এলাকায়। পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায় বদলে গেছে সেসব জায়গার পরিবেশ। বদলে গেছে এমনকি সেসব স্থানের নামও। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ এবং প্রাথমিক ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিকে আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
বাংলাবাজার
ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এ জায়গাটি মূলত বই বিক্রয়, প্রকাশনা ও সরবরাহের জন্য বিখ্যাত। ঢাকার অস্তিত্ব যখন থেকে শুনা যায় ঠিক তখন থেকে বাংলা বাজারের অস্তিত্ব ছিল। ঢাকায় যখন মুঘলদের আগমনও ঘটেনি তখনো বাংলাবাজার সমৃদ্ধির উচ্চে অবস্থান করছিল। সুলতানী আমলে এই বাংলাবাজার পরিচিত ছিল বেংগলা নগরী নামে। সুলতানি যুগে একাধিক ইউরোপীয় পরিব্রাজক বেংগলা নগরীর কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের বর্ণনা অনুযায়ী এই বেংগলা নগরে বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট সুতা ও সিল্কের বস্ত্র উৎপাদিত হত৷ ধারণা করা হয়, এই পরিব্রাজকরা মসলিন বস্ত্রের গুণগানই করেছেন। ঢাকায় মুঘল অধিকারের সময় প্রাচীন এই বেংগলা নগরী নদীর পশ্চিম তীর বেয়ে এগিয়ে যায় এবং চকবাজারে সুবা বাংলার কেন্দ্রস্থলে গিয়ে পর্যবসিত হয়৷ কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিকদের ব্যাপক গবেষণার ভিত্তিতে শেষপর্যন্ত এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যেই বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির এই বেংগলা নগরীই আজকের বাংলাবাজার। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে জিপিও ভবন থেকে ইস্টার্ন ক্রসিং পর্যন্ত বাংলাবাজার রেলস্টেশন রোডকে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পিকে রায় রোড৷ আরেকবার এই একই রোডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সুভাস বোস রোড। তবে কোনটাই সাধারণের জনপ্রিয়তা পায়নি। রোডটি এবং এলাকাটি আজো বাংলাবাজার নামেই সমধিক পরিচিত।
পিলখানা
আজকের পিলখানা একসময় ছিল হাতির চারণকেন্দ্র। মুঘল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বন্য হাতি এনে এক বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে পোষ বানানো হত। আর সেইসব হাতির জায়গা হত আজকের পিলখানায়৷ ইংরেজ আমলে এখানে একটি সেনা ছাউনি ছিল। পাকিস্তান আমলে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের সেনানিবাস। বর্তমান প্রজন্মের কাছে পিলখানা জায়গাটি সুপরিচিত হলেও এর নামকরণের পেছনের ইতিহাস জানেনা প্রায় কেউই। কিংবদন্তি আছে, মুঘল আমলে ঢাকার উত্তর পাশে মুঘল সরকারের হাতিশালা ছিল৷ ফার্সি পিল শব্দের অর্থ ছিল হাতি। এক পর্যায়ে এই হাতিশালা পরিত্যক্ত হয়ে শুধুমাত্র সামরিক হাতির অকুস্থল হিসেবে বিবেচিত হয়৷ ঢাকা পিলখানা মুঘল আমলের পরও হাতির চারণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। ব্রিটিশ আমলে সরকারি হাতি রাখার পাশাপাশিও অনেক বেসরকারি মালিকানার হাতিও পিলখানায় রাখা হত, সেজন্য সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হত।
বাদামতলী
ধারণা করা হয় সুবাদার শায়েস্তা খানের হাত ধরেই বাদামতলীর পত্তন হয়। এখানে পান্থগণ নবাবের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। পালিশ করা কাঠের একটা চতুর্ভুজ ঘেরাওয়ের মধ্যে নবাব বাস করতেন। ঘাটের উপর ছিল নহবতখানা এবং এরই পশ্চিম দিকে ছিল নবাব শায়েস্তা খানের কন্যা লাভলী বেগমের সমাধি স্তম্ভ৷ সম্ভবত এখানে বাদাম উৎপন্ন হত কিংবা পাইকারি ভাবে বাদাম কেনাবেচা করা হত বলে জায়গাটির নাম হয়ে যায় বাদামতলী।
বাসাবো
ঢাকার বাসাবো এলাকাতে একসময় ঢাকার নবাবদের খাজনা আদায় পরিচালনা কেন্দ্র ছিল। স্থানীয় লোকেরা তার তত্ত্বাবধান করত। খাজনা আদায়ের তহশিল অফিসকে বলা হত 'নবাবের বাসাবাড়ি'। তারো পরে এই অফিসকে বলা হত বাসাবাড়ি। আর এই বাসাবাড়ি থেকে কালক্রমে বাসাবো নামের উৎপত্তি হয়৷
পল্টন
আজকের নয়া পল্টন বা পুরানা পল্টন শব্দটি এসেছে প্লাটুন থেকে। ঢাকার অন্যতম প্রাচীন এ এলাকায় মুঘল আমলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে সেনানিবাস গঠিত হয়েছিল৷ তার ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও এখানে নতুন করে সেনাছাউনি স্থাপন করা হয় যার নাম দেয়া হয়েছিল পল্টন। সেই সেনাছাউনির আদিনাম সময়ের বিবর্তনে পল্টনই রয়ে গেছে।
ফকিরাপুল
ফকিরাপুলের নামকরণের পেছনে এক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে৷ কিংবদন্তি বলছে এ এলাকায় একসময় চার প্রভাবশালী ফকিরের বাস ছিল। তারা মারা গেলে হঠাৎ করে তাদের কবরে অলৌকিকভাবে একটি সাঁকোর সৃষ্টি হয়। সেই থেকে এই সাঁকোটি ফকিরের পুল নামে খ্যাত হয়। আর এই ফকিরের পুল লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে ফকিরাপুল রূপ ধারণ করে৷ আজ থেকে দুই যুগ আগেও এই পুলের অস্তিত্ব ছিল যেখানে অনেক মানুষই সন্ধ্যায় চেরাগ জ্বেলে দিত।
লেখক উবায়দুর রহমান রাজু